প্রশ্ন: সুলতানি আমলে দিল্লি শহরের নাগরিক বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল। ৫ নং
উত্তর: দিল্লি সুলতানি আমলে শহরটি মুসলিম স্থাপত্য, সংস্কৃতি এবং শাসনের এক প্রাণবন্ত কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লি এক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে রূপান্তরিত হয়, যার নাগরিক বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।
দিল্লির নাগরিক বৈশিষ্ট্য
সুলতানি আমলে দিল্লির নাগরিক বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল মূলত নিম্নরূপ:
* দুর্গ ও প্রাচীর ঘেরা শহর: দিল্লির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর সুরক্ষিত নগর পরিকল্পনা। আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরকে প্রায়শই শক্তিশালী প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হতো। যেমন, তুঘলকাবাদ ছিল একটি বিশাল দুর্গ-শহর, যা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নির্মাণ করেছিলেন। এর বিশাল প্রাচীর এবং সুসংগঠিত প্রবেশদ্বারগুলো ছিল তৎকালীন নিরাপত্তার প্রতীক। এই প্রাচীরগুলো কেবল সুরক্ষা দিত না, বরং শহরের সীমানা নির্ধারণ করত এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দিত।
* বহু-কেন্দ্রিক নগর বিন্যাস: দিল্লি সুলতানি আমলে একটি একক শহর ছিল না, বরং বিভিন্ন সময়ে সুলতানরা ভিন্ন ভিন্ন এলাকা বা "শহর" নির্মাণ করেছিলেন, যা একত্রিত হয়ে বৃহত্তর দিল্লি গঠন করেছিল। যেমন:
* কিলা রাই পিথোরা: এটি ছিল সম্ভবত প্রথম দিকের একটি শহর, যা মুহাম্মদ ঘোরীর বিজয়ের পর মুসলিম শাসনে আসে।
* সিঁড়ি: আলাউদ্দিন খলজি এটি নির্মাণ করেন মোঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
* তুঘলকাবাদ: গিয়াসউদ্দিন তুঘলক দ্বারা নির্মিত একটি শক্তিশালী দুর্গ-শহর।
* ফিরোজাবাদ: ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বারা নির্মিত একটি নতুন শহর, যা ফিরোজ শাহ কোটলা নামে পরিচিত।
এই বহু-কেন্দ্রিক বিন্যাস শহরটিকে একটি বিশাল এবং বিস্তৃত মহানগরীতে পরিণত করেছিল, যেখানে প্রতিটি "শহর" এর নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী এবং কার্যকারিতা ছিল।
* স্থাপত্যিক ঐশ্বর্য: সুলতানি আমলে দিল্লিতে এক নতুন স্থাপত্য শৈলীর বিকাশ ঘটে, যা ভারতীয় ও ইসলামিক ঐতিহ্যের মিশ্রণ ছিল। কুতুব মিনার, আলাই দরওয়াজা, কুতুব কমপ্লেক্সের মতো অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার এবং সমাধি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই স্থাপত্যগুলো কেবল ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করত না, বরং মুসলিম শাসকদের ক্ষমতা ও সংস্কৃতির প্রতীক ছিল। এগুলোর নকশায় জটিল জ্যামিতিক বিন্যাস, ক্যালিগ্রাফি এবং ইটের কাজের ব্যবহার দেখা যেত, যা শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত।
* জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা: একটি উন্নত নগরীর জন্য জল সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং সুলতানরা এ বিষয়ে সজাগ ছিলেন। দিল্লিতে কূপ, খাল এবং জলাধার নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে শহরের অধিবাসীরা পর্যাপ্ত জল পায়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে জল সরবরাহের জন্য খাল খননের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক মানের ছিল না, তবে এটি তৎকালীন সময়ের জন্য বেশ উন্নত ছিল, যা শহরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাহায্য করত।
* বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্র: দিল্লি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। শহরের বিভিন্ন স্থানে জমজমাট বাজার গড়ে উঠেছিল, যেখানে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বণিকরা পণ্য লেনদেন করত। বস্ত্র, মশলা, শস্য, মূল্যবান ধাতু, এবং হস্তশিল্পের পণ্য কেনাবেচা হতো। এই বাজারগুলো ছিল শহরের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষের মিলনস্থল। বণিকদের আনাগোনা শহরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
* শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র: সুলতানি আমলে দিল্লি ছিল জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির একটি প্রধান কেন্দ্র। অসংখ্য মাদ্রাসা, খানকাহ (সুফি কেন্দ্র) এবং পাঠাগার গড়ে উঠেছিল, যেখানে ইসলামিক আইন, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্যের চর্চা হতো। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে জ্ঞান অর্জনের জন্য আসত। অনেক পন্ডিত, সুফি সাধক এবং কবি দিল্লিকে তাদের বাসস্থান বানিয়েছিলেন, যা শহরের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল।
* জনসংখ্যার বৈচিত্র্য: দিল্লি সুলতানি আমলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের আবাসস্থল ছিল। স্থানীয় ভারতীয়দের পাশাপাশি মধ্য এশিয়া, পারস্য এবং অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে আগত মানুষজন এখানে বসবাস করত। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শহরের ভাষা, রীতিনীতি, পোশাক এবং খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলেছিল, যা দিল্লিকে একটি কসমোপলিটান শহরে পরিণত করে।
সংক্ষেপে, সুলতানি আমলে দিল্লি ছিল একটি সুরক্ষিত, বহু-কেন্দ্রিক, স্থাপত্যিক দিক থেকে সমৃদ্ধ, বাণিজ্যিকভাবে সক্রিয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ নগরী। এর সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা এটিকে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত করেছিল।