প্রশ্ন : আকবরের রাজপুত নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো। প্রশ্নের মান ৫
উত্তর: আকবরের রাজপুত নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণের এক কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল।
∆ আকবরের রাজপুত নীতির মূল দিক:-
ক) বৈবাহিক সম্পর্ক: আকবর রাজপুত রাজকন্যাদের বিবাহ করে (যেমন, অম্বরের রাজা ভারমলের কন্যা হরখা বাই) মিত্রতা স্থাপন করেন, যা পারস্পরিক বিশ্বাস বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
খ) উচ্চপদে নিয়োগ: তিনি রাজপুত নেতাদের মুঘল প্রশাসনে উচ্চ সামরিক ও বেসামরিক পদে নিয়োগ করেন (যেমন, রাজা মানসিংহ, রাজা টোডরমল), যা তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করে।
গ) ধর্মীয় সহনশীলতা: আকবর জিজিয়া কর বাতিল করেন এবং রাজপুতদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য পালনের অধিকার দেন, যা তাদের সম্মান ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
ঘ) স্বায়ত্তশাসন: রাজপুত রাজ্যগুলিকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়, যা তাদের মুঘল শাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাব কমাতে সাহায্য করে।
ঙ) সম্মান ও মর্যাদা: আকবর রাজপুতদের বীরত্বের কদর করতেন এবং তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতেন, যা দীর্ঘস্থায়ী মৈত্রী গড়ে তোলে।
∆ ফলাফল:-
এই নীতির ফলে মুঘল সাম্রাজ্য আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়। রাজপুতরা বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
এখানে ১০ নং মানের জন্য উত্তরটি দেওয়া হলো
আকবরের রাজপুত নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই নীতির মাধ্যমে আকবর সামরিক শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে সমঝোতা ও মৈত্রীর মাধ্যমে রাজপুতদের সমর্থন আদায় করে মুঘল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেন।
আকবরের রাজপুত নীতির মূল বৈশিষ্ট্য:
* বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন: আকবর রাজপুতদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে তার নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে অম্বরের রাজা ভারমল তার কন্যা হরখা বাইকে আকবরের সাথে বিবাহ দেন। পরবর্তীকালে আকবরের পুত্র সেলিমের (জাহাঙ্গীর) সাথে ভগবানদাসের কন্যারও বিবাহ হয়। এই ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক রাজপুতদের মধ্যে মুঘলদের প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করে।
* উচ্চপদে নিয়োগ: আকবর অনেক রাজপুত রাজপুত্র ও নেতাদের মুঘল প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তাদের সামরিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা কাজে লাগানো হয়। রাজা মানসিংহ, রাজা টোডরমল প্রমুখ রাজপুত নেতারা মুঘল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে ওঠেন।
* ধর্মীয় সহনশীলতা ও স্বাধীনতা: আকবর রাজপুতদের প্রতি ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি জিজিয়া কর (হিন্দুদের উপর আরোপিত এক প্রকার কর) বাতিল করেন এবং তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন। অনেক রাজপুত তাদের নিজ নিজ রাজ্যে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারত।
* সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা: আকবর রাজপুতদের সম্মান বজায় রেখেছিলেন এবং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি রাজপুতদের নিজস্ব আইন ও ঐতিহ্য মেনে চলতে দিতেন।
আকবরের রাজপুত নীতি গ্রহণের কারণ:
* সাম্রাজ্য বিস্তার ও সুদৃঢ়করণ: আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজপুতদের বিরোধিতা করে ভারতবর্ষে দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বরং তাদের সহযোগিতা পেলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
* রাজপুতদের সামরিক শক্তি: রাজপুতরা ছিল ভারতের অন্যতম শক্তিশালী ও সাহসী যোদ্ধা জাতি। তাদের সামরিক শক্তিকে নিজের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন আকবর।
* হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: আকবর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে একটি বিশাল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কেবল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে। রাজপুতদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তিনি এই ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
* আফগান বিদ্রোহ দমন: আফগানরা মুঘলদের প্রতিপক্ষ ছিল। রাজপুতদের সমর্থন পেলে আফগানদের দমন করা সহজ হবে বলে আকবর মনে করেন।
আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল:
* মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি: রাজপুত সৈন্যদের মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে মুঘলদের সামরিক শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
* সাম্রাজ্যের বিস্তার ও স্থায়িত্ব: রাজপুতদের সক্রিয় সমর্থন মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তারে এবং একটি সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আকবরের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
* হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সহাবস্থান: এই নীতির ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। আকবরকে হিন্দু জাতির কাছে "জাতীয় নরপতি" হিসেবে গণ্য করা হয়।
* প্রশাসনিক সুবিধা: উচ্চপদে রাজপুতদের নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে দক্ষতা ও শৃঙ্খলা আসে।
ঐতিহাসিকদের মতামত:
অধিকাংশ ঐতিহাসিক আকবরের রাজপুত নীতিকে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে মনে করেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতো কিছু ঐতিহাসিক আকবরের এই নীতিকে "নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ" বলে অভিহিত করলেও, অনেকেই মনে করেন যে এই নীতির মধ্যে উদারতা ও সহনশীলতার স্পর্শ ছিল। আকবর রাজপুতদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করেননি, বরং তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছিলেন।
সংক্ষেপে, আকবরের রাজপুত নীতি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব, বিস্তার এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছিল।