প্রশ্ন : শেরশাহের শাসনব্যবস্থা আলোচনা করো। প্রশ্নের মান ৫ নং
উত্তর : শেরশাহের শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, জনকল্যাণমুখী এবং দূরদর্শী। মাত্র ৫ বছরের রাজত্বকালে (১৫৪০-১৫৪৫ খ্রি.) তিনি যে প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন, তা ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
শেরশাহের শাসনব্যবস্থা :-
ক) কেন্দ্রীভূত শাসন: শেরশাহ একজন নিরঙ্কুশ শাসক হয়েও প্রজাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি শাসনকার্যে সহায়তার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্মচারী নিয়োগ করেন।
খ) প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন: সাম্রাজ্যকে সরকার (প্রদেশ) ও পরগণায় বিভক্ত করে দক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রাম ছিল সর্বনিম্ন স্তর, যা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিচালিত হত।
গ) ভূমি রাজস্ব সংস্কার (শ্রেষ্ঠ কীর্তি):
১) সমগ্র জমির বৈজ্ঞানিক জরিপ করে উর্বরতা অনুযায়ী ভাগ করা হয়।
২) উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ রাজস্ব হিসাবে ধার্য করা হত।
৩) 'পাট্টা' ও 'কবুলিয়ত' প্রথা চালু করে কৃষকদের জমির স্বত্ব ও দায়িত্ব নিশ্চিত করেন।
৪) প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিমা তহবিল গঠন করেন।
ঘ) সামরিক সংস্কার: একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ঘোড়ার দাগ এবং সৈন্যদের বিস্তারিত তালিকা রাখার প্রথা চালু করেন।
ঙ) বিচার ব্যবস্থা: অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ বিচার ব্যবস্থা ছিল, যেখানে কোনো বৈষম্য ছিল না।
চ) যোগাযোগ ও বাণিজ্য:
১) 'সড়ক-ই-আযম' (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) সহ বহু রাস্তা নির্মাণ করেন।
২) পথচারীদের জন্য সরাইখানা ও বৃক্ষরোপণ করেন।
৩) মুদ্রা সংস্কার করে বিশুদ্ধ রূপার 'টঙ্কা' প্রচলন করেন।
৪) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য অযৌক্তিক শুল্ক তুলে দেন।
শেরশাহের এই সুসংগঠিত শাসনব্যবস্থা পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্য, বিশেষত আকবরের প্রশাসনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
এখানে ১০ নং মানের জন্য উত্তরটি দেওয়া হল:
উত্তর: শেরশাহের শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, জনকল্যাণমুখী এবং দূরদর্শী। মাত্র ৫ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বকালে (১৫৪০-১৫৪৫ খ্রি.) তিনি যে প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন, তা পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবরের জন্যও অনুপ্রেরণা ছিল। তাঁর শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা:
শেরশাহ ছিলেন একজন নিরঙ্কুশ শাসক। সকল ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলেও তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। তিনি শাসনকার্যে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। যেমন - দেওয়ান-ই-উজিরাত (রাজস্ব), দেওয়ান-ই-আরজ (সামরিক), দেওয়ান-ই-ইনসা (যোগাযোগ) এবং দেওয়ান-ই-রিসালত (বিদেশি বিভাগ)।
২. প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন:
শাসনের সুবিধার্থে শেরশাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে (প্রদেশ) এবং প্রতিটি সরকারকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করেন। গ্রাম ছিল প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর।
ক) সরকার: প্রতিটি সরকারের প্রধান ছিলেন শিকদার-ই-শিকদারান (মুখ্য শিকদার) এবং মুনসিফ-ই-মুনসিফান (মুখ্য মুনসিফ)। এঁরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন।
খ) পরগণা: পরগণার প্রধান ছিলেন শিকদার (আইন-শৃঙ্খলা), আমিন (ভূমি রাজস্ব), কোষাধ্যক্ষ, হিসাবরক্ষক (একজন হিন্দু ও একজন ফার্সি কর্মচারী)।
গ) গ্রাম: গ্রাম স্বায়ত্তশাসিত ছিল এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত বা মোকাদ্দমরা গ্রাম্য শাসন পরিচালনা করতেন।
৩. ভূমি রাজস্ব সংস্কার (শেরশাহের শ্রেষ্ঠ কীর্তি):
শেরশাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ছিল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। তিনি কৃষকদের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
ক) ভূমি জরিপ: তিনি সমগ্র জমি জরিপ করে উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করেন - উত্তম, মধ্যম ও নিকৃষ্ট।
খ) রাজস্ব নির্ধারণ: উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ অথবা ১/৪ অংশ রাজস্ব হিসাবে ধার্য করা হত। এটি নগদ অর্থ বা শস্য উভয় আকারেই পরিশোধ করা যেত।
গ) পাট্টা ও কবুলিয়ত: কৃষকদের জমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তিনি 'পাট্টা' (জমির স্বত্বের দলিল) এবং 'কবুলিয়ত' (চুক্তি দলিল) প্রথা চালু করেন। এতে কৃষকদের অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত।
ঘ) বিমা তহবিল: প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলে কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বিঘা প্রতি আড়াই সের শস্য হিসাবে একটি বিমা তহবিল গঠন করেন, যা থেকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হতো।
৪. সামরিক সংস্কার:
শেরশাহ একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন।
ক) তিনি সৈন্যদের সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং নগদ বেতনের ব্যবস্থা করেন।
খ) ঘোড়ার দাগ (অশ্ব চিহ্নিতকরণ) এবং সৈন্যদের বিবরণমূলক তালিকা রাখার প্রথা চালু করেন, যাতে কোনো অসাধুতা না ঘটে।
গ) তিনি স্বয়ং সেনাবাহিনীর তদারকি করতেন।
৫. বিচার ব্যবস্থা:
শেরশাহ ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর বিচার ব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচুর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না।
ক) প্রতিটি পরগণায় কাজী ও মীর আদিল ফৌজদারী মোকদ্দমা এবং মুনসিফ-ই-মুনসিফান দেওয়ানী মামলার বিচার করতেন।
খ) কাজী-উল-কুজ্জাত বা প্রধান কাজী ফৌজদারী বিচার তদারক করতেন এবং স্বয়ং সম্রাট নিজেও গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার করতেন।
৬. ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি:
শেরশাহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন।
ক) সড়ক নির্মাণ: তিনি বহু সুন্দর ও প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো 'সড়ক-ই-আযম' (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড), যা বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে পাকিস্তানের সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খ) সরাইখানা ও বৃক্ষরোপণ: পথচারী ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দু'পাশে বৃক্ষরোপণ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে সরাইখানা নির্মাণ করেন। এই সরাইখানাগুলো ডাকচৌকি হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
গ) মুদ্রা সংস্কার: তিনি মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং বিশুদ্ধ রূপার মুদ্রা (টঙ্কা) ও তামার মুদ্রা 'দাম' প্রচলন করেন।
ঘ) শুল্কনীতি: তিনি হয়রানিমূলক কর তুলে দিয়ে কেবলমাত্র সীমান্তে অথবা বিক্রয়ের স্থলে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক হয়।
৭. গুপ্তচর ও পুলিশ ব্যবস্থা:
আইনশৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য শেরশাহ একটি দক্ষ গুপ্তচর ও পুলিশী ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের ওপর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল।
ঐতিহাসিক কিনের মতে, "কোনো সরকারই এমনকি ব্রিটিশ সরকারও শেরশাহের মতো শাসন কার্যে বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেননি।" ড. কানুনগো, ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণও শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর স্বল্পকালীন শাসন হলেও তা ভারতীয় ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।