প্রশ্ন : বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে এবং কোথায় এই রাজ্যটি গড়ে ওঠে? পর্যটকদের চোখে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা লেখো।
উত্তর: বিজয়নগর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন হরিহর এবং বুক্কা নামে দুই ভাই। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে, বর্তমান কর্ণাটকের হাম্পির কাছে তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ তীরে এই রাজ্যটি গড়ে ওঠে। সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয়েছিল এর রাজধানী বিজয়নগরের নামে, যার ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে হাম্পিতে দেখা যায়।
পর্যটকদের চোখে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের বর্ণনা:
বিজয়নগর সাম্রাজ্য তার ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি এবং স্থাপত্যের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আসা বহু পর্যটকদের মুগ্ধ করেছিল। তাদের লেখায় এই সাম্রাজ্যের এক ঝলমলে চিত্র ফুটে ওঠে। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য পর্যটক এবং তাদের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:
* নিকোলো ডি কন্টি (ইতালীয় পর্যটক, ১৪২০-এর দশকে): তিনি বিজয়নগরের বিপুল সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে শহরটি ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং এর পরিধি ছিল প্রায় ৬০ মাইল। তিনি অনুমান করেছিলেন যে এই শহরে প্রায় ৯০,০০০ সশস্ত্র পুরুষ ছিল। রাজা প্রথম দেব রায়ের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে, "অন্যান্য ভারতীয় রাজাদের চেয়ে এই রাজা বেশি শক্তিশালী" এবং তার "১২ হাজার স্ত্রী ছিল, যার মধ্যে চার হাজার তাকে পদব্রজে অনুসরণ করত এবং শুধুমাত্র রান্নার কাজে নিযুক্ত ছিল।"
* আব্দুর রাজ্জাক (পারস্যের রাজদূত, ১৪৪০-এর দশকে): তিনি বিজয়নগরের বিশালত্ব এবং জনবসতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সাতটি কেন্দ্রীভূত পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা শহরের বর্ণনা দিয়েছেন, যার বাইরের প্রাচীরগুলো ছিল অত্যন্ত মজবুত এবং প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত। তিনি বাগান, উদ্যান, দালান, দোকান এবং বাজারের কথা উল্লেখ করেছেন। আব্দুর রাজ্জাক রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের শাসনকে "নিখুঁত" বলে বর্ণনা করেছেন এবং অনুমান করেছেন যে রাজার এক হাজারেরও বেশি হাতি এবং ১.১ মিলিয়ন সৈন্য ছিল। তিনি শহরের বাজারগুলোর বিশালতা এবং ফুলের প্রাচুর্যের কথাও বলেছেন।
* ডোমিংগো পেস (পর্তুগিজ পর্যটক, ১৫২০-এর দশকে): কৃষ্ণদেব রায়ের শাসনামলে তিনি বিজয়নগর পরিদর্শন করেন এবং তার বর্ণনায় এই সাম্রাজ্যকে "রোম" এর সাথে তুলনা করেন। তিনি "বিজয়নগর রাজাদের উপাখ্যান" (Chronica dos Reis de Bisnaga) গ্রন্থে বিজয়নগর সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। পেস উন্নত সেচ ব্যবস্থা দেখে বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন, যা প্রচুর ফসল উৎপাদনে সাহায্য করত। তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে বাজারগুলো মূল্যবান পাথরে পূর্ণ ছিল এবং শহরটি গাছপালা, জলাশয় এবং কৃত্রিম হ্রদ দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। পেস বিজয়নগরের সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং নারীদের ভূমিকা, যেমন উৎসবে অংশগ্রহণ, এবং কিছু নারীর প্রভাবের কথাও উল্লেখ করেছেন।
* ফেরনাও নুনিজ (পর্তুগিজ পর্যটক): তিনি বিজয়নগর সাম্রাজ্যে সতীপ্রথা এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলনের কথা উল্লেখ করেছেন।
এই পর্যটকদের বিবরণী থেকে বোঝা যায় যে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ, সুসংগঠিত এবং স্থাপত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নত। এর বিশাল শহর, সুরক্ষিত দুর্গ, জমজমাট বাজার এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এই বর্ণনাগুলো বিজয়নগরের তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে।