প্রশ্ন :আকবরের নবরত্ন সভা ও রাজা বীরবল সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: আকবরের নবরত্ন সভা ও রাজা বীরবল
আকবরের শাসনকালে তাঁর দরবারে নয়জন গুণী ব্যক্তি ছিলেন, যাঁদের নবরত্ন বলা হতো। এই রত্নরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং আকবরের সাম্রাজ্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
নবরত্নদের পরিচয়:
* আবুল ফজল: আকবরের প্রধান উপদেষ্টা ও ঐতিহাসিক।
* ফৈজি: রাজকবি ও আবুল ফজলের ভাই।
* তানসেন: কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ।
* রাজা টোডরমল: অর্থমন্ত্রী ও রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারক।
* রাজা মানসিংহ: সেনাপতি ও বিশ্বস্ত রাজপুত মিত্র।
* আব্দুর রহিম খান-ই-খানা: কবি ও সেনাপতি।
* ফকির আজিওদ্দিন: ধর্মীয় উপদেষ্টা।
* মির্জা আজিজ কোকা: আকবরের পালিত ভাই ও প্রশাসক।
* রাজা বীরবল: আকবরের বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান মন্ত্রী।
রাজা বীরবল:
* আসল নাম মহেশ দাস ভাট।
* আকবরের নবরত্নদের মধ্যে অন্যতম ও তাঁর খুবই প্রিয় বন্ধু।
* তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, রসবোধ ও উপস্থিত বুদ্ধির জন্য সুপরিচিত।
* "আকবর-বীরবল কাহিনি" নামে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত গল্পগুলি ভারতীয় লোককথায় অত্যন্ত জনপ্রিয়।
* আকবরের প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করতেন।
* ১৫৮৬ সালে এক সামরিক অভিযানে তাঁর মৃত্যু হয়, যা আকবরকে গভীরভাবে শোকাহত করে।
বীরবল তাঁর প্রজ্ঞা ও রসবোধের জন্য আজও ভারতীয় ইতিহাসে স্মরণীয়।
বা,
১০ নং এর জন্য তৈরি করে দেওয়া হলো।
আকবরের নবরত্ন সভা:
সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল (১৫৫৬-১৬০৫) ভারতীয় ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্য এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পাশাপাশি তাঁর দরবারের সংস্কৃতিও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। আকবরের দরবারে এমন নয়জন প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন, যাঁদের সম্মিলিতভাবে "নবরত্ন" বলা হত। এই নবরত্নরা কেবল তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে পারদর্শীই ছিলেন না, বরং আকবরের শাসন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই নবরত্নরা হলেন:
* আবুল ফজল: আকবরের প্রধান উপদেষ্টা, ইতিহাসবিদ এবং আইনজ্ঞ। তিনি 'আকবরনামা' ও 'আইন-ই-আকবরী' রচয়িতা।
* ফৈজি: আবুল ফজলের ভাই এবং আকবরের সভাকবি। তিনি ফারসি ভাষায় অনেক কাব্য রচনা করেন।
* তানসেন: একজন কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা এতটাই ছিল যে বলা হত, তিনি মেঘ নামাতে ও বৃষ্টি ঝরাতে পারতেন।
* রাজা বীরবল: আকবরের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধিমান মন্ত্রী। তাঁর রসবোধ এবং প্রজ্ঞা জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো)
* রাজা টোডরমল: আকবরের অর্থমন্ত্রী এবং তাঁর রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারক। তাঁর "জাবতি" বা "দহশালা" পদ্ধতি রাজস্ব আদায়ে বিপ্লব এনেছিল।
* রাজা মানসিংহ: আকবরের সেনাপতি এবং বিশ্বস্ত রাজপুত মিত্র। অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি আকবরের হয়ে নেতৃত্ব দেন।
* আব্দুর রহিম খান-ই-খানা: একজন বিখ্যাত কবি এবং সেনাপতি। তিনি বাবরের পুত্র ছিলেন এবং তুর্কি ভাষার পাশাপাশি ফারসি ও হিন্দিতেও কবিতা লিখতেন।
* ফকির আজিওদ্দিন: আকবরের একজন ধর্মীয় উপদেষ্টা এবং সুফি সাধক।
* মির্জা আজিজ কোকা: আকবরের পালিত ভাই এবং একজন দক্ষ প্রশাসক ও সেনাপতি।
এই নবরত্নরা আকবরের দরবারকে জ্ঞান, শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। তাঁরা আকবরের উদারনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
রাজা বীরবল:
রাজা বীরবল (আসল নাম মহেশ দাস ভাট) ছিলেন আকবরের নবরত্নদের মধ্যে অন্যতম এবং আকবরের অত্যন্ত প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু। তাঁর রসবোধ, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং তাৎক্ষণিক বুদ্ধি তাঁকে সকলের কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। তাঁর জন্ম ১৫২৮ সালে মধ্যপ্রদেশের কালিয়ারে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে।
বীরবল আকবরের দরবারে শুধুমাত্র একজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা ছিলেন না, তিনি ছিলেন আকবরের একজন ব্যক্তিগত বন্ধু। তাঁর সাথে আকবরের বিভিন্ন কৌতুকপূর্ণ আলোচনা এবং বীরবলের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাহিনি ভারতীয় লোককথায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। "আকবর-বীরবল কাহিনি" নামে অসংখ্য গল্প প্রচলিত আছে, যা শিশুদের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। এই গল্পগুলিতে বীরবলের উপস্থিত বুদ্ধি, রসবোধ, ন্যায়পরায়ণতা এবং সমস্যা সমাধানের অসাধারণ ক্ষমতা ফুটে ওঠে।
বীরবল আকবরের সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তিনি বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে অংশগ্রহণ করতেন এবং জটিল সমস্যা সমাধানে আকবরকে সহায়তা করতেন। তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা এবং প্রজ্ঞা তাঁকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও পরিচিতি এনে দেয়।
১৫৮৬ সালে ইউসুফজাই উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনের জন্য আকবর বীরবলকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাঠান। এই অভিযানে বীরবল নিহত হন, যা আকবরের জন্য একটি বিশাল ব্যক্তিগত ক্ষতি ছিল। বীরবলের মৃত্যুতে আকবর এতটাই শোকাহত হয়েছিলেন যে তিনি কয়েকদিন অন্ন-জল ত্যাগ করেছিলেন।
সংক্ষেপে, আকবরের নবরত্ন সভা ছিল তাঁর রাজত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা ভারতে জ্ঞান, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আর রাজা বীরবল ছিলেন সেই নবরত্নদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তাঁর প্রজ্ঞা, রসবোধ এবং বিচক্ষণতা দিয়ে আকবরের রাজত্বকে আরও আলোকিত করেছিলেন এবং আজও ভারতীয় লোককথায় অমর হয়ে আছেন।