প্রশ্ন : জাবতি ব্যবস্থার পরিচয় দাও।
জাবতি ব্যবস্থা: আকবরের ভূমি রাজস্ব সংস্কার
জাবতি ব্যবস্থা ছিল মুঘল সম্রাট আকবরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যা তাঁর অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল ১৫৮০-১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা কৃষকদের উপর রাজস্বের বোঝা কমানো এবং সরকারের রাজস্ব আদায়কে সুসংহত করার লক্ষ্য নিয়ে চালু হয়েছিল।
মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:
* জমির জরিপ ও শ্রেণীকরণ: কৃষিজমিগুলোকে উর্বরতার ভিত্তিতে পোলাজ (প্রতি বছর চাষ), পারউতি (কিছু সময় পতিত), চাচর (৩-৪ বছর পর চাষ) এবং বনজর (৫+ বছর অনাবাদি) - এই চারটি ভাগে ভাগ করা হতো।
* দশ বছরের গড় (দহশালা): পূর্ববর্তী দশ বছরের ফসলের গড় উৎপাদন ও বাজার মূল্যের ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা হতো। এতে কৃষকরা তাদের নির্দিষ্ট রাজস্ব সম্পর্কে আগাম জানতে পারত।
* নগদ অর্থে রাজস্ব: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় করা হতো, যা রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনছিল।
* কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি হ্রাস: জমির সঠিক পরিমাপ ও নির্ধারিত রাজস্ব হারের কারণে স্থানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয়েছিল।
* কৃষকদের নিরাপত্তা: এই সুসংহত ব্যবস্থা কৃষকদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও যুক্তিসঙ্গত রাজস্ব নিশ্চিত করে, যা কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
জাবতি ব্যবস্থা মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে এবং আকবরের বিচক্ষণ প্রশাসনিক নীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেছিল।
বা,
জাবতি ব্যবস্থা ছিল মুঘল সম্রাট আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্যবস্থাটি ১৫৮০-১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল প্রবর্তন করেন। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে এবং কৃষকদের উপর রাজস্বের বোঝা কমাতে সহায়ক হয়েছিল।
জাবতি ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
১. জমির জরিপ ও শ্রেণীকরণ: এই ব্যবস্থায়, কৃষিজমিগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জরিপ করা হতো। জরিপের ভিত্তিতে জমিকে উর্বরতা এবং চাষের ইতিহাসের উপর নির্ভর করে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়:
* পোলাজ: যে জমিতে প্রতি বছর চাষ করা যেত।
* পারউতি: যে জমি উর্বরতা বজায় রাখার জন্য কিছু সময় পতিত রাখা হতো।
* চাচর: যে জমি তিন বা চার বছর পর পর আবাদ করা হতো।
* বনজর: যে জমি পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ধরে অনাবাদি পড়ে থাকত।
২. দশ বছরের গড় উৎপাদন ও মূল্য নির্ধারণ (দহশালা): এই ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল "দহশালা" পদ্ধতি। পূর্ববর্তী্ন : দশ বছরের প্রতিটি ফসলের গড় উৎপাদন এবং গড় বাজার মূল্য হিসাব করা হতো। এই দশ বছরের গড় উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩ অংশ) রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হতো। এর ফলে প্রতি বছর রাজস্বের পরিমাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কমে আসে এবং কৃষকরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব সম্পর্কে অবগত থাকতে পারত।
৩. নগদ অর্থে রাজস্ব আদায়: জাবতি ব্যবস্থায় সাধারণত নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় করা হতো। যদিও কিছু ক্ষেত্রে শস্যের মাধ্যমে রাজস্ব প্রদানের সুযোগ ছিল, তবে নগদ অর্থই বেশি পছন্দনীয় ছিল। বিভিন্ন ফসলের জন্য নগদ রাজস্বের হার (দস্তুর) নির্ধারিত ছিল।
৪. কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি হ্রাস: এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। জমির সঠিক পরিমাপ এবং রাজস্বের হার নির্দিষ্ট হওয়ায় স্থানীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা দুর্নীতির সুযোগ অনেক কমে আসে।
৫. কৃষকদের নিরাপত্তা: জাবতি ব্যবস্থা কৃষকদের উপর রাজস্বের চাপ কমাতে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়ক ছিল। একটি নির্দিষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত রাজস্ব ব্যবস্থা তাদের মধ্যে স্থিতিশীলতা এনেছিল।
গুরুত্ব:
জাবতি ব্যবস্থা মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ছিল। এটি কৃষকদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল রাজস্ব ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছিল এবং সরকারের রাজস্ব আদায়কে আরও কার্যকর করে তুলেছিল। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সাম্রাজ্যের আর্থিক বুনিয়াদ মজবুত হয়। এই ব্যবস্থা আকবরের বিচক্ষণ প্রশাসনিক নীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।