প্রশ্ন : রাজা কৃষ্ণদেব রায় এর শাসনকাল সম্পর্কে যা জানো লেখ। প্রশ্নের মান ৫ নং
উত্তর: রাজা কৃষ্ণদেব রায় (শাসনকাল: ১৫০৯-১৫২৯ খ্রি.) ছিলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক এবং তাঁর সময়কাল ছিল বিজয়নগরের স্বর্ণযুগ। তিনি তুলুভ রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
* সামরিক বিজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার:
* তিনি উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবকে পরাজিত করে পূর্বতন হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।
* বিজাপুরের সুলতানদের হারিয়ে রায়চুর দোয়াব দখল করেন, যা তাঁর সামরিক শক্তির প্রমাণ।
* পর্তুগিজদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে আধুনিক সামরিক জ্ঞান ও ঘোড়া সংগ্রহ করেন।
* সুশাসন ও অর্থনীতি:
* তিনি বিচক্ষণতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন এবং প্রজাদের কল্যাণের দিকে সজাগ ছিলেন।
* বনাঞ্চলকে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন।
* নিয়মিত রাজ্য পরিদর্শন করে প্রজাদের সমস্যা সমাধান করতেন।
* শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা:
* তাঁর রাজত্বকাল তেলুগু সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজেও 'অমুক্তমাল্যদা' নামক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
* তাঁর দরবারে 'অষ্টদিগগজ' নামে আটজন শ্রেষ্ঠ তেলুগু কবি ও পণ্ডিত ছিলেন, যার মধ্যে আল্লাসানি পেড্ডানা ও তেনালি রামকৃষ্ণ অন্যতম।
* তিনি কন্নড় ও সংস্কৃত সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
* স্থাপত্য: বিজয়নগরে বহু মন্দির, হ্রদ ও খাল নির্মাণ করেন।
কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন একজন পরাক্রমশালী যোদ্ধা, বিচক্ষণ প্রশাসক ও শিল্প-সাহিত্যের মহান পৃষ্ঠপোষক, যা বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।
বা,
রাজা কৃষ্ণদেব রায় এর শাসনকাল:
রাজা কৃষ্ণদেব রায় (শাসনকাল: ১৫০৯-১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের তুলুভ রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর রাজত্বকাল বিজয়নগরের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তিনি কেবল একজন পরাক্রমশালী যোদ্ধা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারকারীই ছিলেন না, একজন বিচক্ষণ প্রশাসক, শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রজাবৎসল রাজা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল।
তাঁর শাসনকালের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো:
১. সামরিক বিজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার:
* উড়িষ্যার গজপতিদের বিরুদ্ধে বিজয়: কৃষ্ণদেব রায় উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবকে একাধিকবার পরাজিত করে উদয়গিরি, কোণ্ডভিডু সহ বিজয়নগরের পূর্বতন হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। শেষ পর্যন্ত গজপতি তাঁর কন্যাকে কৃষ্ণদেব রায়ের সাথে বিবাহ দিয়ে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হন।
* বিজাপুরের সুলতানদের বিরুদ্ধে সাফল্য: তিনি বিজাপুরের সুলতানদের পরাস্ত করে রায়চুর দোয়াব দখল করেন, যা তাঁর সামরিক শক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
* পর্তুগিজদের সাথে সম্পর্ক: তিনি পর্তুগিজদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাদের কাছ থেকে আধুনিক সামরিক কৌশল ও ঘোড়া সংগ্রহ করে নিজের সামরিক শক্তি আরও বাড়ান।
২. প্রশাসন ও অর্থনীতি:
* সুশাসন ও প্রজাদের কল্যাণ: কৃষ্ণদেব রায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি প্রজাদের কল্যাণের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন এবং কিছু জনকল্যাণমূলক কর (যেমন বিবাহ-কর) বাতিল করেন।
* রাজস্ব বৃদ্ধি: তিনি বনাঞ্চলকে আবাদী জমিতে পরিণত করে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন।
* পর্যবেক্ষণ: তিনি নিজে নিয়মিত রাজ্যের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করতেন এবং প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন।
* দুর্নীতি দমন: মন্ত্রীদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন এবং যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
৩. শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা:
* সাহিত্যের স্বর্ণযুগ: কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকাল তেলুগু সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান পণ্ডিত ও লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত তেলুগু কাব্যগ্রন্থ হলো 'অমুক্তমাল্যদা'।
* অষ্টদিগগজ: তাঁর রাজদরবারে আটজন শ্রেষ্ঠ তেলুগু কবি বা পণ্ডিতের একটি পরিষদ ছিল, যাদের "অষ্টদিগগজ" বলা হতো। এদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন আল্লাসানি পেড্ডানা (যাকে অন্ধ্রকবিতা-পিতামহ বলা হতো) এবং তেনালি রামকৃষ্ণ।
* অন্যান্য ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা: তিনি কেবল তেলুগু নয়, কন্নড় ও সংস্কৃত সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
৪. স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা:
* তিনি বিজয়নগরের আশেপাশে বহু মন্দির, হ্রদ এবং খাল নির্মাণ করেন, যা তাঁর নগর পরিকল্পনা ও জনকল্যাণমূলক কাজের পরিচায়ক। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েস তাঁর রাজধানী বিজয়নগরের সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেছেন।
উপসংহার:
কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন মধ্যযুগের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তাঁর সামরিক বিজয়, বিচক্ষণ প্রশাসন, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ এবং প্রজাবৎসল মনোভাব বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বিজয়নগরের সেই গৌরব আর ফিরে আসেনি।