মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারসমূহ
মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ) দিল্লির সুলতানি আমলের একজন ব্যতিক্রমী শাসক ছিলেন। তিনি বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়নের ত্রুটি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়।
১. দোয়াবে রাজস্ব বৃদ্ধি:
গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে কৃষকদের উপর রাজস্ব বাড়ানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাজকোষের আয় বৃদ্ধি, কিন্তু এই সময় দুর্ভিক্ষ হওয়ায় কৃষকদের বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
২. রাজধানী স্থানান্তর:
দিল্লি থেকে দেবগিরি (দৌলতাবাদ)-তে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও মঙ্গল আক্রমণ থেকে সুরক্ষা। তবে, অপরিকল্পিতভাবে স্থানান্তরের ফলে ব্যাপক জনদুর্ভোগ হয় এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লিই রাজধানী থেকে যায়।
৩. প্রতীকী মুদ্রা প্রচলন:
সোনা-রূপার সংকট মোকাবিলায় তামা ও পিতলের প্রতীকী মুদ্রা চালু করেন, যার মূল্য সোনা-রূপার সমান ছিল। কিন্তু জাল মুদ্রা রোধের অভাবে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং সুলতানকে এই মুদ্রা প্রত্যাহার করতে হয়, যা রাজকোষকে আরও শূন্য করে দেয়।
৪. কৃষি সংস্কার (দেওয়ান-ই-কোহি):
কৃষির উন্নতির জন্য 'দেওয়ান-ই-কোহি' নামে একটি নতুন কৃষি দপ্তর চালু করেন। এর মাধ্যমে পতিত জমি আবাদ এবং কৃষকদের ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে এটিও সফল হয়নি।
৫. খোরাসান ও কারাচিল অভিযান:
সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় খোরাসান ও কারাচিল অভিযান-এর পরিকল্পনা করেন। খোরাসান অভিযান বাতিল হয় এবং কারাচিল অভিযান প্রতিকূলতার কারণে ব্যর্থ হয়, যা রাজকোষের বিপুল ক্ষতি করে।
পর্যালোচনা:
মহম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারগুলো দূরদর্শী হলেও, তার হঠকারিতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং জনগণের অসহযোগিতার কারণে সেগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। ফলস্বরূপ, তিনি 'উন্মাদ সুলতান' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
বা,
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারসমূহ
মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দিল্লির সুলতানি আমলের একজন অত্যন্ত বিতর্কিত এবং ব্যতিক্রমী শাসক। তিনি বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, যার বেশিরভাগই তার সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। তবে, বাস্তবায়নের ত্রুটি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই সংস্কারগুলি প্রায়শই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তাকে "উন্মাদ সুলতান" আখ্যা দেওয়া হয়। তার প্রধান সংস্কারগুলো নিচে পর্যালোচনা করা হলো:
১. দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি:
মুহাম্মদ বিন তুঘলক গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজকোষের আয় বৃদ্ধি করা। তবে, এই সময়ে দোয়াবে একটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজস্ব বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত কৃষকদের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং তাদের বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে। যদিও সুলতান পরে ঋণ ও ত্রাণ ব্যবস্থা চালু করেন, ততক্ষণে কৃষকদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
২. রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৬-২৭ খ্রি.):
দিল্লি থেকে দেবগিরিতে (দৌলতাবাদ) রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ছিল তার সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল বলে মনে করা হয়:
* কেন্দ্রীয় অবস্থান: দেবগিরি সাম্রাজ্যের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় সুলতান মনে করেছিলেন যে এখান থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যকে আরও দক্ষতার সাথে শাসন করা যাবে।
* মঙ্গল আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা: বারবার মঙ্গল আক্রমণের ফলে দিল্লি সুরক্ষিত ছিল না, তাই রাজধানী স্থানান্তরের মাধ্যমে তিনি মঙ্গল আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
* দাক্ষিণাত্যের উপর নিয়ন্ত্রণ: দাক্ষিণাত্যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যও এর পেছনে ছিল।
তবে, এই স্থানান্তর অত্যন্ত অগোছালোভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। দিল্লিবাসীদের জোরপূর্বক দেবগিরিতে নিয়ে যাওয়া হয়, যার ফলে পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় এবং ব্যাপক দুর্ভোগ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত, প্রশাসনিক অসুবিধার কারণে তাকে আবার দিল্লিতে ফিরে আসতে হয়, যা রাজকোষের উপর প্রচন্ড বোঝা চাপিয়েছিল।
৩. প্রতীকী মুদ্রা (Token Currency) প্রচলন (১৩২৯-৩০ খ্রি.):
রাজকোষের শূন্যতা এবং সোনা-রূপার সংকট মোকাবিলায় মুহাম্মদ বিন তুঘলক প্রতীকী মুদ্রা (তামা ও পিতলের মুদ্রা) চালু করেন, যার মূল্য সোনা-রূপার মুদ্রার সমতুল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই ধারণাটি আধুনিক কাগজের মুদ্রার ধারণার সঙ্গে তুলনীয় এবং চীন ও পারস্যে এর সফল দৃষ্টান্ত ছিল।
কিন্তু, এই পরিকল্পনার মূল দুর্বলতা ছিল জাল মুদ্রা প্রতিরোধের অভাব। জনগণ সহজেই ঘরে ঘরে মুদ্রা তৈরি করতে শুরু করে, যার ফলে বাজারে জাল মুদ্রার বন্যা দেখা দেয়। অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এতটাই বেড়ে যায় যে সুলতানকে এই মুদ্রা প্রত্যাহার করতে হয় এবং জাল মুদ্রার বিনিময়ে রাজকোষ থেকে আসল সোনা-রূপার মুদ্রা দিতে হয়, যা রাজকোষকে আরও শূন্য করে দেয়।
৪. কৃষি সংস্কার (দেওয়ান-ই-কোহি):
মুহাম্মদ বিন তুঘলক কৃষির উন্নতির জন্য 'দেওয়ান-ই-কোহি' নামে একটি নতুন কৃষি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পতিত জমিকে চাষের আওতায় আনা এবং কৃষকদের ঋণ (তাকাভি) ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা। এই প্রকল্পের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। তবে, অনুপযুক্ত জমি নির্বাচন, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থার কারণে এই প্রকল্পটিও সফল হয়নি।
৫. খোরাসান ও কারাচিল অভিযান:
সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মুহাম্মদ বিন তুঘলক খোরাসান ও কারাচিল অভিযানের পরিকল্পনা করেন। খোরাসান অভিযানের জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করা হয় এবং অগ্রিম বেতন প্রদান করা হয়। কিন্তু, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় এই অভিযান বাতিল হয়, যার ফলে রাজকোষের বিপুল অর্থ নষ্ট হয়। কারাচিল অভিযান প্রাথমিকভাবে সফল হলেও, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং বিদ্রোহী উপজাতিদের আক্রমণের কারণে এই সেনাবাহিনীও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়।
পর্যালোচনা:
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সংস্কারগুলি দূরদর্শী এবং মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচায়ক ছিল। তিনি প্রচলিত শাসনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। তার পরিকল্পনাগুলি সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল, তবে, তার ব্যক্তিত্বের ত্রুটি, যেমন অধৈর্যতা, হঠকারিতা এবং কঠোরতা; উপযুক্ত প্রশাসনিক কাঠামোর অভাব; জনগণের অসহযোগিতা; এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এই সব কারণগুলি তার চমৎকার পরিকল্পনাগুলিকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। ফলে তিনি আধুনিক ঐতিহাসিকদের কাছে "ম্যান অফ আইডিয়াস" হলেও সমসাময়িকদের কাছে "উন্মাদ সুলতান" হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।